শিশুসাহিত্যে নজরুল

আসলাম আহসান: বাংলা শিশুসাহিত্যে সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় রবীন্দ্রনাথের নাম। এরই ধারাবাহিকতায় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, তার যোগ্য উত্তরসূরি সুকুমার রায় এবং তার পুত্র সত্যজিৎ রায় অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত। এ পরিসরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এক হীরণয় নাম। কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য একান্তই নজরুলীয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এক জায়গায় কবি বলেছেন, ‘আমি চিরশিশু চির কিশোর’ সব অর্থেই কথাটা সত্যি। যতদিন সুস্থ ছিলেন, সদা চঞ্চল এক শিশুসত্তা তার মধ্যে নৃত্যপর ছিল। শিশুমনস্তত্ত্ব ভালো বুঝতেন নজরুল। শিশুর স্বপ্নজগৎ, মা-বাবার সঙ্গে খুনসুটি, পড়াশোনায় অমনোযোগ, খেলাধুলা, দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা- সবই কবি তুলে এনেছেন শিশুদের উপভোগ্য ভাষায়, চিত্রকল্পে।

শিশুদের কথা ভেবে লেখা নজরুলের কোনো গল্প উপন্যাস বা প্রবন্ধ নেই। ছড়া, কবিতা, গান ও নাটিকায় ছড়িয়ে কবির শিশুতোষ রচনাসমূহ। দুটি ভাগে ভাগ করা যায় তার শিশুসাহিত্যকে। প্রথম ভাগে আছে নিতান্ত খোকা-খুকুদের জন্য লেখা পাঠ্যপুস্তকধর্মী কিশোর রচনা। সহজ সরল হাস্যকৌতুক নিয়ে এর গড়ন। দ্বিতীয় বিভাগের রচনায় আছে কিশোর-কিশোরীদের উচ্চতর জীবন গঠনের আহ্বান।

রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় কবি ‘চড়ুই পাখির ছানা’ নামে কবিতা লেখেন। এটিকে কবির প্রথম দিকের শিশুতোষ রচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পরিণত রচনা হিসেবে ছোটদের জন্য লেখা নজরুলের সবচেয়ে প্রিয় ছড়া-কবিতার বই ‘ঝিঙ্গে ফুল’ (১৯২৬)। পাঠে বোঝা যায়, শিশুসাহিত্যের উপকরণ নজরুল নিয়েছেন শিশুর মান-অভিমান-ক্রীড়া-কৌতুক থেকে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে; অভিধান থেকে নয়। একটি উদাহরণ স্মরণ করা যাক। ১৯২১ সালের কথা। কবি বেড়াতে গেছেন কুমিল্লায়। উঠেছেন ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তর বাড়িতে। সে বাড়িতে ছোট-বড় সবাই নজরুলের ভক্ত-বন্ধু। অঞ্জলি নামে ইন্দ্রবাবুর ছোট্ট একটি মেয়ে। সে-ও ভিড়ে যায় নজরুলের বন্ধুবৃত্তে। একদিন কবি দেখেন, একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কৌতূহলী কবি কাছে গিয়ে দেখলেন কথা বলার সঙ্গীটি একটি কাঠবিড়ালি। এ দৃশ্য কবিকে অভিভূত করে। তিনি লেখেন তার স্মরণীয় শিশুতোষ কবিতা ‘খুকি ও কাঠবেরালি।’ কাঠবিড়ালি মজা করে গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। খুকি তাকে ভোলানোর চেষ্টা করছে, যদি একটা পেয়ারা পাওয়া যায়!

ইস্! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খুব পেয়ারা খাই যে একটি আমায় দাও!

প্রশংসায় লাভ হয় না কোনো। শেষে রেগেমেগে রীতিমতো ‘শাপ’ ‘কাঠবেরালি! তুমি মরো! তুমি কচু খাও!!’

‘লিচু-চোর’ ছড়াটির বড় গুণের ছন্দদোলা। পড়তে পড়তে শরীর দুলতে শুরু করে। অভিনয় উপযোগী এমন চমৎকার শিশুতোষ কবিতা বাংলাসাহিত্যে বিরল। এর কিছু পঙ্্ক্তি একালে প্রবাদ বাক্যের মতোই উদ্ধৃত হয়, ‘পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই/ যে ছিল গাছের আড়েই।’

‘প্রভাতী’ এ বইয়ের অনুপম সুন্দর একটি ছড়া। সকালের এমন সুন্দর বর্ণনা বাংলা শিশুসাহিত্যে খুব বেশি নেই। কবি ডাক দিচ্ছেন, ভোর হয়েছো, খুকুমণি! এবার উঠে পড়ো! আর ঘুমানো যাবে না। এ কবিতায় প্রভাত-সূর্য হয়ে উঠেছে ‘রবি মামা’, যুঁই হয়েছে ‘ফুল-খুকি’।

শিশুমনে কখনো কখনো ‘বড়’ হওয়ার ইচ্ছে জাগে। নামতা পড়তে পড়তে তার মনে হয়,

আমি বাবা হতাম বাবা হতো খোকা
না হলে তার নামতা পড়া মারতাম মাথায় টোকা।

কী অদ্ভুত দুষ্টুমি ভরা চিন্তা! ‘নবার নামতা পড়া’ও বেশ মজার একটি ছড়া। নবার এক চোখ নামতায়, অন্য চোখে বাবাকে দেখছে সাবধানে। বাবা কখন অফিসে যাবে! বাবা অফিসে গেলেই ব্যস, আর পড়তে হবে না! পড়ার ফাঁকে তার চোখ যায় উঠানের কুল গাছে, নাকে আসে আচারের ঘ্রাণ।

একেক্কে এক/ বাবা কোথায়, দেখ্।/ দুয়েক্কে দুই
নেইক? একটু শুই!

নয়েক্কে নয়/ আর একটু ভয়। / দশেককে দশ/ বাবা আপিস! ব্যস!

দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ তালগাছ দেখে শিশুর মনে হয়, গাছটা বুঝি ওরই মতো মাস্টার মশায়ের কাছে দ-প্রাপ্ত আসামি। পড়া মুখস্থ হয়নি বলে একপায়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। শিশু জানতে চায়

ঝাঁকড়া-চুলো তালগাছ তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই
আমার মতো পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই।
খোকার মুখ দিয়ে, এ যেন স্কুল-পালানো বালক নজরুলের ভাষ্য!

অঝোর ধারায় গান লিখেছেন কবি। ছোটদের জন্য লেখা গানের মধ্যে চিত্ররূপময় একটি গান প্রজাপতি নিয়ে। এমন রঙিন পাখা সে কোথায় পেল, শিশুর মনে অপার বিস্ময়,

প্রজাপতি! প্রজাপতি!
কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন রাখা
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা ॥

এ ছাড়া ‘খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর-জলে’, ‘চমকে চমকে ভীরু ভীরু পায়’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী’ এসব গানও শিশুমন চঞ্চল করে তোলে।

শিশুদের কবি নিছক শিশু হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন অমিত সম্ভাবনার আধার হিসেবে। তাই, অলস ঘুমে অসাড় পড়ে না থেকে তাকে ‘সকাল বেলার পাখি’ হওয়ার কথা বলেছেন। বুঝিয়েছেন, সকাল হওয়াটা সূর্য ওঠা না-ওঠার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে মানুষের জেগে ওঠার ওপর,

‘তোমার ছেলে উঠলে মাগো তার পোহাবে তবে।’

এই পঙ্্ক্তির ভিন্ন পাঠটিও তাৎপর্যপূর্ণ, ‘তোমার মেয়ে উঠলে মাগো তার পোহাবে তবে।’

‘পুতুলের বিয়ে’ নজরুলে বেশ উপভোগ্য একটি নাটিকা। সহজ সরল কাহিনি বিন্যাসে এখানে কবি শিশুর মনোজগৎ স্পর্শ করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। এ নাটিকার একটি গানের বাণী হয়ে উঠেছে চিরকালীন সম্প্রীতির বাণী,

‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ॥’

যেমনটি সূচনায় বলা হয়েছে, নজরুলের শিশুসাহিত্য একান্তই নজরুলীয়। শিশুকিশোরদের, একই সঙ্গে সব বয়সী পাঠকের কাছেই আনন্দের উৎস। সে কারণেই তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *