শহীদ কাদরী: কম লিখে পেয়েছেন বেশি খ্যাতি: এস ডি সুব্রত

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।’ (তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা- শহীদ কাদরী।)

বাংলা সাহিত্যে যেসব কবি কম লিখে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শক্তিমান কবি শহীদ কাদরী। তার কবিতায় নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি নাগরিক জীবন ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ প্রকাশ পায়। মাত্র চারখানা প্রকাশিত গ্রন্থ এবং কিছু অপ্রকাশিত কবিতার জন্য একটি দেশের কাব্যভুবনে অসামান্য খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। শহীদ কাদরীর কবিতার বিরাট একটা অংশে রয়েছে নাগরিক জীবনচিত্রের এক অনন্য স্বরূপ। কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি প্রবাসজীবন কাটাতে শুরু করেন জার্মানিতে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। তার পর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটান। কবি শহীদ কাদরী ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। প্রবাস জীবনেও তিনি লেখালেখিতে খুব সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন অসামান্য দক্ষতায়। শহীদ কাদরী খুব একটা প্রথাগত ছন্দনির্ভর কবিতা লেখেননি। তার একটা নিজস্বতা রয়েছে। চৌদ্দ বছর বয়সে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত একটি সংকলনে তার লেখা প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবি শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেই পুরো সাহিত্যাঙ্গনে সাড়া ফেলে দেন কবি শহীদ কাদরী। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় ‘প্রেম বিরহ ভালবাসার কবিতা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং প্রবাসে লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশ পায় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও।’ শহীদ কাদরী প্রবাসে থেকে যে কবিতাগুলো লিখেছেন, তার অধিকাংশই স্বদেশভূমির জন্য তার বিরহকাতরতাপূর্ণ। তিনি দেশ থেকে বহু দূরে থেকেও কখনোই দেশকে ভোলেননি। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনাকে কবি মেনে নিতে পারেননি। মৌলবাদের নখদন্ত তাকে প্রবলভাবে আহত করে। তাই তো তিনি ঘৃণাভরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেন কবিতার পঙ্‌ক্তিতে। শৈশবের মাত্র ১০ বছর তিনি কলকাতা শহরে কাটিয়েছিলেন। অথচ, সেই শহরের স্মৃতি তিনি আজীবন লালন করেছেন। অভিজাত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হলেও ভালোভাবে বাংলা শেখার আগে তিনি শিখেছেন উর্দু ও ইংরেজি। নাগরিক, শহুরে জীবনের আলো ও অন্ধকার দুটোই তার দেখা। তাই তো তার কবিতায় পাপচেতনার চরম উপলব্ধির দেখা মেলে। শহীদ কাদরীর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে। শহীদ কাদরী তরুণদের মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তিনি অনেক কম লিখেও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন। এই তো বোধ হয় একজন কবির সার্থকতা। শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। প্রকাশক মফিদুল হক তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার অতিসাম্প্রতিক সৃষ্টি-প্রাচুর্যের ভিড়ে তাকে কেউ খুঁজে পাবেন না। অথচ সাতচল্লিশ-উত্তর কবিতাধারায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সঞ্চারিত করে কবিতার রূপ বদলে যাঁরা ছিলেন কারিগর, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে, ঝলমলে বিশ্ব-নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে তিনি যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাসন করে পরমুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন দূর দিগন্তের নিভৃত নির্জনতার কোলে।’

কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক এক সাক্ষাৎকারে শহীদ কাদরী সম্পর্কে বলেন- ‘এক অসাধারণ মানুষ শহীদ কাদরী। বিশাল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মেধায়, আড্ডায় সব মিলিয়ে একজন মানুষ হিসেবে শহীদ কাদরীর কোনো তুলনা চলে না। আমার জীবনে আমি যা কিছু কিঞ্চিৎ শিখেছি তা শহীদের জন্যই।’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *