মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রাম

আবদুল্লাহ আল আমিন: ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের। যে-পবিত্র মাটি থেকে নবী মুহাম্মদ (সা.) ‘আরোহণ করেছিলেন স্বর্গে, ফিরে এসেছিলেন উদ্যম আর খুশি নিয়ে’ সেই পবিত্র মাটি বর্বরের বেয়নেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। জলপাইয়ের ডালে কোনো পাখি আর ভোরের আকাশকে স্বাগত জানায় না, বন্ধ হয়ে গেছে সব পথসংগীত, নিভে গেছে সব আলো। প্রতিটি যুবক ভুলে গেছে সাদা টিউলিপ, জলপাইয়ের ডাল আর ‘প্রেমিকার স্তনযুগলের’ স্বপ্ন দেখা। সেখানে কোনো স্বপ্নচারী কিশোর কিংবা যুবা আর ভোরের ‘পাখির স্বপ্ন’ দেখে না, শোনে না কোনো ‘লেবুফুলের গল্প’। জেরুজালেমের বুকেও যুদ্ধের দগদগে ক্ষত, সেই ক্ষত থেকে জেগে উঠছে ‘বাইবেলের একেকটি সাদা গোলাপ’। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলায় পুরো উপত্যকাটির বেশির ভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাবারের তীব্র সংকট, বোমার আঘাতে হাজার হাজার শিশু পঙ্গুত্ব বরণ করছে, ছড়িয়ে পড়েছে রোগবালাই। সংঘাত, অপুষ্টি ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির কারণে গাজায় এমন এক ‘প্রাণঘাতী চক্র’ সৃষ্টি হয়েছে যে পুরো উপত্যকার লাখ লাখ শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে মিশর সীমান্তবর্তী রাফা এলাকায় লাখ লাখ বেসামরিক বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছে, দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লেবাননে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে অনেক মানুষ। পৌনে একশ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নিগৃহীত, উৎপীড়িত, উদ্বাস্তু, নিজ বাসভূমেই পরবাসী। আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে, ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিনের চারশো গ্রাম দখল করে ধ্বংস করে দেয় এবং সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে তোলে ইহুদি বসতি। ধ্বংস করে দেওয়া হয় গালিলি প্রদেশের বন্দরনগরী অ্যাকারের নিকটবর্তী আল-বিরওয়া গ্রামটিও। এই গ্রামেই বাস করতেন হুসাইন দারবিশ নামে এক কাব্যপ্রেমী প্রবীণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন গল্প, কবিতা আর শ্লোকের আসর বসতো, সেই শ্লোকগুলি ছিল খুবই রোমান্টিক। দারবিশ নামে এক মুগ্ধ বালক মনোযোগ সহকারে এই শ্লোকগুলি শুনতো। শ্লোকের মর্মার্থ হয়তো সে তেমন বুঝতো না, তবুও শব্দের ঝংকারে বালক দারবিশ অভিভূত, পুলকিত, শিহরিত হতেন; কবিতার সঙ্গে নিত্য বসবাস করতে করতে সেই মুগ্ধ বালক হয়ে ওঠেন স্বপ্নচারী, আকাশবিহারী। ‘বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও’ – এমন প্রশ্ন করতেই বালক উত্তর দেয়, বড় হয়ে সে কবি হবে, কবিতা রচনা করবে। এই স্বপ্নচারী বালকের নাম মাহমুদ দারবিশ, কাব্যপ্রেমী হুসাইন দারবিশের পৌত্র। এই বালকই একসময়ে হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর, আরবি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮)। ১৯৪৮ সাল, যখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁদের ঘরবাড়িসহ পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। আরো অনেক ফিলিস্তিনি পরিবারের মতো দারবিশের পরিবার প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রথমে জেদিদি এবং পরে দামুর অঞ্চলে। শুরু হয় উদ্বাস্তু-জীবন, স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট স্থানে থিতু হতে পারেন না। উদ্বাস্তু জীবন কাটাতে হয় মস্কো, প্যারিস, বৈরুত, দামেস্ক, আম্মান ও তিউনিসিয়ায়। উদ্বাস্তু অবস্থায় দারবিশের স্কুলজীবন শুরু হয় জাদিদি থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে কাফর ইয়াসিফে, তারপর দীর্ঘ সময় হাইফাতে। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’

ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ (গাজী সাইফুল ইসলাম-অনূদিত মাহমুদ দারবিশের কবিতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৯, পৃ ভূমিকা) তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। দারবিশও বিংশ শতাব্দীর এক মহান ব্যক্তি যাকে আরবি ভাষার প্রধান কবি এবং ফিলিস্তিনের জাতীয় কবির অভিধায় ভূষিত করা হয়। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে তাঁর প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।

প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। ১৯৪১ সালের ১৩ই মার্চ ফিলিস্তিনের উত্তর গালিলির গ্রাম আল বারওয়াহে এক মুসলিম

কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া দারবিশ পিতামহ হুসাইন দারবিশকে সদ্বংশজাত এক স্বশিক্ষিত কৃষক হিসেবে বর্ণনা করে নিজ ও জাতির আত্মপরিচয় উন্মোচন করেছেন। তাঁর ‘পরিচয়পত্র’ কবিতায় পিতামহই হয়ে ওঠেন আরব জাতির প্রতীক, তিনিই তাঁকে ‘শিক্ষা দিয়েছিলেন কীভাবে পড়তে হয়’। পিতামাতা ক্ষেত-খামারের কাজে থাকার কারণে তিনি বড় হয়েছেন পিতামহের স্নেহচ্ছায়ায়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী দারবিশের গ্রামটি দখল করে নিলে আক্রান্ত হয়ে দারবিশের পরিবার আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। জাতিসংঘের সামান্য সাহায্যে তাঁদের উদ্বাস্তু-জীবন কাটাতে হয়। প্রায় ৯ লাখ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছিল।

উদ্বাস্তু-জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দারবিশ লিখেছেন, ‘আমি উদ্বাস্তু হিসেবে জীবনযাপন করেছি। এটা ছিল যৌথ অভিজ্ঞতা। এই ক্ষত আমি কখনোই ভুলতে পারব না।’ নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে যাপিত জীবনের কথা তাঁর কবিতায় এক অনন্য সুর হয়ে বেজে ওঠে। তাঁর কবিতায় স্বদেশপ্রেম, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ সবই আছে, কেবল নেই পরধর্মবিদ্বেষ, নেই ক্রোধোন্মত্ততা। তাঁর মনের গহনে একটি অনিবার্য প্রশ্ন বারবার জেগে উঠেছে, একই পূর্বপুরুষ (ইয়াকুব আ.), একই ইতিহাসের অংশ হয়েও ইহুদিরা কেন তাদের বিতাড়িত করতে চায়? কেন তারা ফিলিস্তিনিদের পিতার ক্ষেত থেকে বিতাড়িত করতে চায়? কেন এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, আর এর শেষ-ই বা কোথায়? ‘আনা ইউসুফুন, ইয়া আবি’ কবিতায় বেদনার্ত তিনি বলেছেন :

পিতা, আমার ভাইয়েরা আমাকে ভালোবাসে না, থাকতে দেয় না তাদের সঙ্গে তারা আমাকে আঘাত করে নির্মম, ছুড়ে মারে পাথর এবং বলে কটু কথা তারা চায় আমি মরে যাই, এর পর তারা আমার প্রশংসা করবে। তারা আমাকে ঘরে থাকতে দেয় না, আমাকে বাইরে রেখে দরজায় দেয় খিল তারা তোমার ক্ষেত থেকেও আমাকে বিতাড়িত করে (ও আমার পিতা, আমি তোমার ইউসুফ)।

কবি হিসেবে দারবিশ স্বপ্নলোকচারী ছিলেন না, তাই অতিব্যক্তিগতভাবে প্রিজমের ভেতরে বসে কিংবা রঙিন চশমা দিয়ে রৌদ্রঝলসিত উজ্জ্বল পৃথিবীকে দেখতে চাননি। তাঁর রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত কবিহৃদয় কেবলই বেদনা-মথিত, ছিন্নভিন্ন পৃথিবীকে দেখতে পেয়েছে। বেদনার রং দিয়ে এথেন্স এয়ারপোর্টের দুর্বিষহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন :

এথেন্স এয়ারপোর্ট আমাদের লাথিয়ে পাঠায় অন্য আরো এয়ারপোর্ট।/ একজন যোদ্ধা বলে : ‘আমি যুদ্ধ করব কোথায়?’/ এক গর্ভবতী তাকে বলেন : ‘কোথায় আমরা প্রসব করব আমাদের সন্তান?’/ শুল্ককর্তারা বলেন : ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছো?’/ আমরা বলি : ‘সাগর থেকে’/ ‘তোমাদের গন্তব্য?’ ‘সাগর’/ আমাদের দলের এক মহিলা বলেন : ‘এই বোঁচকাই, আমাদের গ্রাম!’/ এথেন্স এয়ারপোর্টে আমরা অপেক্ষা করি বছরের পর বছর।’ (‘এথেন্স এয়ারপোর্ট’, ইংরেজি অনুবাদ : মুনির আকাশ ও ক্যারোলিন ফারশে)

খুব শৈশবেই তিনি কবিতাতে মেতে ওঠেন, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত এক গায়কের কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ দারবিশের মাথায় কবিতার পঙ্ক্তি আর গানের সুর ভর করে। সেই থেকে তাঁর পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমা কবিতার সঙ্গে।

৯ই আগস্ট, ২০০৮-এ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন শহরের হেরমান মেমোরিয়াল হাসপাতালে দারবিশের শেষ নিশ^াস ত্যাগের মধ্য দিয়ে অবসান হয় এক মহৎ পরিক্রমণের। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি দিয়ে তিনি ভরিয়ে রেখেছিলেন আরবি সাহিত্যের বিশাল বনভূমিকে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ডানাহীন পাখি। এরপর প্রকাশিত হয় লিভস অফ দি অলিভ ট্রি (১৯৬৪), এ লাভার ফ্রম প্যালেস্টাইন (১৯৬৬)। এর মধ্যে প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশের পর দারবিশ আরবি ভাষাভাষীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল থেকে প্রকাশিত হয় এন্ড অব দ্য নাইট। এ-সময় তিনি ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি রাকাইর সদস্য ছিলেন এবং সম্পাদনা করতেন পার্টির পত্রিকা আল ইত্তিহাদ। ইসরায়েলিদের বর্বরতা, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে দারবিশ-সম্পাদিত আল ইত্তিহাদ সাহসী ও সময়োপযোগী দায়িত্ব পালন করে। সাহসী, প্রতিবাদী ও লড়াকু ভূমিকা পালনের জন্য তাঁকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে; কখনো কখনো বরণ করতে হয়েছে গৃহবন্দিত্ব।

প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি। ‘পরিণয়পত্র’ কবিতায় তিনি মানবতার জয়গান গেয়ে উচ্চারণ করেছেন :

আমি মানুষকে ঘৃণা করি না।
আমি কারো কাছ থেকে কিছু চুরি করি না
তারপরও যদি আমার ক্ষুধা লাগে
আমি আমার জবরদখলকারীর মাংস খাব
সাবধান … আমার ক্ষুধা থেকে সাবধান
আমার ক্ষুধা থেকে সাবধান।
(‘আইডেন্টিটি কার্ড’, ইংরেজি অনুবাদ : ক্যারোলিন ফরসে ও মুনির আকাশ)

মানুষের প্রতি বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সংগ্রামী ও উদ্বাস্তু জনগণের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করতে গিয়ে দারবিশ ধীর অথচ অবিরাম প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছেন। প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন জবরদখলকারীদের। তাঁর লড়াকু মেজাজের কবিতাগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্যরে হলেও তা পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। কবিতা চলে যায় যুদ্ধশিবিরে, উৎকীর্ণ হয় দেয়ালে দেয়ালে মানবমুক্তির সেøাগান হয়ে। সেইসব কবিতা পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কম্পিত, শিহরিত ও অনুপ্রাণিত হয়। দারবিশ শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির কথা চিন্তা করেননি, পুরো আরব জাহানের নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতাকে স্বজন ভেবেছেন। প্রতিবাদী কবিতা রচনার জন্য বারবার তাঁর জীবনে নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়্গ, রিক্ত নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে বাধ্য হয়েছেন নিজ বাসভূমি ছাড়তে, তারপরও দখলদারদের বিরুদ্ধে নিরাপস লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এভাবেই তাঁর কবিতা আরব জাতিসত্তার উজ্জীবনের অগ্নিঝরা ইশতেহার হয়ে ওঠে। খেটে-খাওয়া গরিব মানুষের মুক্তির কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আরবদের গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস নতুন করে নির্মাণ করেন তিনি। আরবদের গৌরবমণ্ডিত, সাহসদীপ্ত ইতিহাসের পথ ধরেই তিনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সম্ভাবনা খুঁজতে চেষ্টা করেন।

আমি একজন আরব/ আমি দিনরাত কষ্ট করে পাথরখনিতে কাজ করি/ আমার আটটি সন্তান/ এই পাথর থেকেই আমি তাদের রুটি, বইখাতা ও জামা কাপড় দিই/ তবুও আমি তোমাদের দরজায় ভিক্ষা চাই না/ তোমার ভর্ৎসনার প্রাসাদে আমি কুর্নিশ করি না। (‘পরিচয়পত্র’)

পৃথিবীর মহৎ কবিদের মতো দারবিশও ছিলেন প্রেমের ভুবনের নিত্যপরিব্রাজক। তাঁর নারীপ্রেম কখনো কখনো রূপান্তরিত হয় স্বদেশপ্রেমে। তাঁর একটি কবিতায় আছে : ‘ওই রমণীর কথা ও নৈঃশব্দ্য, ফিলিস্তিনি/ তার কণ্ঠ, ফিলিস্তিনি/ তার জন্ম ও মৃত্যু, ফিলিস্তিনি।’ (‘ফিলিস্তিনের প্রেমিক’) ইহুদি তরুণী তামার-বিন-অমির সঙ্গে দারবিশের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেদনাপীড়িত ফিলিস্তিনিদের বেদনায় মথিত-ভারাক্রান্ত হয়ে প্রেমিকার প্রতি তিনি লেখেন : ‘আমি আমার জাতির সঙ্গে বেইমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতা-শৃঙ্খলের বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালোবাসি।’

প্রায় পাঁচ দশকের কাব্য-পরিক্রমায় মাহমুদ দারবিশ অর্জন করেন ফিলিস্তিনের ‘প্রধান কবি’র অভিধা। এই মর্যাদা ও দায়ভার সারাজীবন তিনি বহন করে গেছেন। জীবৎকালে তিনি ছিলেন আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় জননন্দিত কবি। তাঁর কবিতা পাঠের আসর ভরে উঠতো উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে। আরব বিশ্বের যেখানেই তিনি কবিতা পড়তে গেছেন, সেখানেই হাজির হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ২০০০ সালে বৈরুতের স্টেডিয়ামে তিনি কবিতা পড়েছিলেন ২৫ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। তাঁর অনেক কবিতাকে গানে রূপ দেওয়া হয়েছে, যা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘আনা ইউসুফুন, ইয়া আবি’ কবিতাটি সুর করে গেয়েছেন মার্সেল খালিফ।

যুবা-তরুণ-বৃদ্ধ, বাঙালি, এশিয়ান, আফ্রিকান যারাই তাঁর কবিতা পড়েছে তারাই মুগ্ধ হয়েছে। কেবল ফিলিস্তিনি তথা আরব জাহানের পাঠকচিত্তে নয়, সারাবিশ্বের ভাবুক-রসিকচিত্ত তৃপ্ত করেছে তাঁর কবিতা। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পঠিত নন্দিত কবিদের একজন। ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গ তাঁর কবিতার একটি সর্বজনীন প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এজন্য তাঁকে ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর, ফিলিস্তিনিদের আনন্দ-বেদনা ও নির্বাসনের মূর্ত প্রতীক বলে মনে করা হয়। তিনি আরবিতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ইংরেজি, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। হিব্রু অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় ঘটে হিব্রু সাহিত্যের আদি গ্রন্থ তৌরাত এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ও পাবলো নেরুদার সঙ্গে। দারবিশের কবিতায় প্রভাব দেখা যায় ইরাকি কবি আব আল-ওয়াহাব আল বায়াতি এবং বদর সাকের আল-সায়েবের। র্যাঁবো ও গিন্সবার্গ যে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন সেটা অকপটে কবুল করেছেন। নির্মোহভাবে প্রশংসা করেছেন হিব্রু কবি ইয়াহুদা অ্যামিচির, যদিও তিনি দারবিশবিদ্বেষী ছিলেন। দুজনেই একই সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্যিক পটভূমিকে কেন্দ্র করে লেখালেখি করেছেন। অ্যামিচি লিখেছেন দখলদার ইসরায়েলিদের গৌরবগাথা নিয়ে আর দারবিশের লেখায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে আরবদের আত্মপরিচয়ের ইতিহাস।

দারবিশের কবিতায় ফিলিস্তিনি জনগণের ছয় দশকের মুক্তিসংগ্রামের উপেক্ষিত অথচ অনিবার্য বিষয়-আশয় বারবার ফিরে এসেছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড তাঁর কাছে স্বর্গের মতো পবিত্র। এ-মাটিতেই ঈসা (আ.)-এর সংবাদবাহকের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল : ‘যদি বিশ্বাস না করো, তুমি হবে না একজন ঈমানদার।’ (‘জেরুজালেম’) ‘নবী মুহাম্মাদ (সা.) অংশীদার পবিত্র ইতিহাসের।’ এই ভূখণ্ডের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে স্বর্গের পতন হিসেবে তুলনা করেছেন তিনি। দারবিশ স্বপ্ন দেখতেন, ফিলিস্তিনি জনগণের অন্তর্নিহিত সত্তার পুনরুত্থান ঘটবে একদিন আর এর মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন। তাঁর সকল ভালোবাসা, সব আবেগ উজাড় করে দিয়েছিলেন বেদনাপীড়িত মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে। ‘আবার জন্মভূমি’ কবিতায় বেদনার্ত কণ্ঠে বলেছেন :

সবার মতো আমারও জন্ম হয়েছিল
আমার মা আছে, আছে ভাই ও বন্ধুরা, আর অনেক জানালাওয়ালা
একটি বাড়ি, …
আমার আছে ঢেউ যা ছিনিয়ে নিয়েছে
গাঙচিলেরা, আছে আমার ভেতর একান্ত এক টুকরো ছবি
আমার আছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি
আছে চাঁদ পাখিদের গান, আর একটি শাশ্বত জলপাই গাছ।

দারবিশ সারাজীবন কবিতায় নিমগ্ন ছিলেন, কবিতাই ছিল তাঁর আরাধ্য। ১৯ বছর বয়সে লেখা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘ডানাহীন পাখি’ দিয়ে যাত্রা শুরু, কবিতা দিয়েই জীবন-মৃত্যুর গান গেয়ে গেছেন। কবিতার জন্য জেলেও অন্তরীণ হয়েছেন। ইসরায়েলি পুলিশকে লক্ষ করে দারবিশ ‘পরিচয়পত্র’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন,

লিখে নিন
আমি এক আবার,
পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার

কবিতাটি প্রকাশিত হলে দারদিশকে গৃহবন্দি করা হয়। পরে কবিতাটি গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর ‘মা’ কবিতাটিও গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। কারাগারে অন্তরীণ পুত্র মায়ের হাতে বানানো রুটি আর কফির জন্য নস্টালজিয়ায় কাতর হয়ে গেয়ে উঠেছেন এভাবে :

আমি আমার মায়ের বানানো রুটির জন্য ব্যাকুল
আমি ব্যাকুল আমার মায়ের বানানো কফির জন্য
আমি ব্যাকুল আমার মায়ের ছোঁয়ার জন্য …

কবিতাটি প্রসঙ্গে দারবিশ বলেছেন, এটি একটি কোরাস। আমার সব কবিতায় এরকম, নিজেকে উপস্থাপন করা ছাড়া কোনো কিছুই আমি কবিতায় তুলে ধরি না। আমি উপস্থাপন করি ‘সম্মিলিত স্মৃতিকে’। দারবিশ ‘সম্মিলিত স্মৃতি’ বলতে ফিলিস্তিনের মা-মাটি আর মানুষকে বুঝিয়েছেন। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে আর কাউকে নিজ বাসভূমিতেই করেছিল পরবাসী। অন্যান্য সব ফিলিস্তিনির মতো দারবিশও ছিলেন দেশহীন, গৃহহারা, উদ্বাস্তু। তাই বেদনার্ত কণ্ঠে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : ‘আমার কোনো বাড়ি নেই/… বাড়ি শব্দ যে গভীর অর্থ বহন করে সেই অর্থে বাড়ি আমার নেই।’ তিনি সব সময় জায়নবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন না। ইসরায়েলের বিখ্যাত কবি য়িহুদা আমিচাইয়ের প্রতি ছিল তাঁর পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন : ‘আমি সবকিছুকে মানবিক করে যাবো, এমনকি শত্রুকেও … প্রথম যে শিক্ষক আমাকে হিব্রু শিখিয়েছিলেন তিনি ছিলেন ইহুদি। প্রথম যে মেয়েটিকে ভালোবাসি সেও ছিল এক ইহুদি/ প্রথম যে আমাকে জেলে পাঠায়, সেই বিচারকও ছিলেন এক ইহুদি নারী। ফলে জীবনের শুরু থেকে আমি এটাই দেখিনি যে, ইহুদি মাত্রই শয়তান কিংবা ফেরেশতা, দেখেছি তারাও মানুষ।’ সাদা লিলিফুল, জলপাই গাছ, ‘চাঁদ আর পাখিদের গান’-এ মুগ্ধ ও বিমোহিত দারবিশকে বারবার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি ইসরায়েল ছেড়ে পলিটিক্যাল ইকোনমি পড়তে মস্কো যান। এক বছর পর মোহভঙ্গ হলে মস্কো ছেড়ে কায়রো এবং পরে বৈরুত চলে আসেন। তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসেও কিছুকাল কাটান। ১৯৮৫ সাল থেকে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি জীবনে থিতু হতে চেয়েছেন, আর এর জন্য তিনি বিয়ে করেছেন সিরীয় কবি নিজার কাব্বানির বোন রানা কাব্বানিকে। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। এক দশক পরে বিয়ে করেন মিশরীয় অনুবাদক হায়াৎ হিলিকে। তাও ভেঙে যায়। ভাঙন ও বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো জীবনের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। কবিতার ভাষা, প্রকরণ জায়গা বদলে ফেলার মতো জীবনের প্যাটার্নকেও তিনি বদলেছেন। কবিতাকে যেমন ভালোবেসেছেন, তেমনি ভালোবেসেছেন জীনকেও। তিনি মনে করতেন : ‘জীবনের ধর্ম প্রেম ও প্রেমে পড়া।’ তিনি ১৯৮৭ সালে পিএলও’র সদস্য হন। লেখালেখির পাশাপাশি ফিলিস্তিনি মুক্তি-আন্দোলনের এক সক্রিয় সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রের মুসাবিদা প্রণয়ন করেন। কেবল ফিলিস্তিনি সংগ্রাম নয়, সারাবিশ্বের সকল মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ছিল তাঁর গভীর সমর্থন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কেও তাঁর জানার আগ্রহ ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ করে তিনি জেনেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমস্যা-সম্ভাবনা এবং শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে। পৃথিবীর সকল মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে দারবিশের ছিল হার্দিক সম্পর্ক। নাইজেরিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক ওলে সোয়িঙ্কা, মার্কিন লেখক রাসেল ব্যাস্কস, মার্কিন চলচ্চিত্রকার অলিভার স্টোন, পর্তুগিজ নোবেল বিজয়ী লেখক হোসে সারামাগো ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু। তবে গভীর সম্পর্ক ছিল সমসাময়িক ফিলিস্তিনি (পরে মার্কিন) চিন্তানায়ক, ‘প্রাচ্যবাদ’-খ্যাত এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে। আদর্শ ও দর্শনগত দিক দিয়ে তাঁরা দুজনে খুবই কাছাকাছি ছিলেন। দারবিশ ও সাঈদ দুজনেই জায়নবাদের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ছিলেন অবিচল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দারবিশের কবিতা সাঈদের চিন্তাজগৎকে আলোড়িত-বিস্ফোরিত করেছে, দারবিশের কবিতার ভুবনও ছিল সাঈদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তার অনুগামী। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে দারবিশ ও সাঈদ দুজনেই ছিলেন সামনের কাতারের সৈনিক। সাঈদের উদ্দেশে লেখা এক কবিতায় দারবিশ উচ্চারণ করেছিলেন –

তিনি শেষ মহাকাব্যের মহানায়কের মতো
ট্রয়ের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছেন
অন্যদের নিজের ন্যারেটিভের ভাগ দেওয়ার জন্য।

সাঈদের মতো মাহমুদ দারবিশও ছিলেন ‘আকাশের মতো উঁচু’ এক মহানায়ক। তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালা মহাকালের সামনে দাঁড়াবে নম্র বিনয়ে নয়, দাঁড়াবে উদ্ধত স্পর্ধায় – এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উচ্চারিত হবে আগ্রাসন ও যুদ্ধবিরোধী মিছিলের সম্মুখ সারি থেকে, উৎকীর্ণ হবে মানবতার দেয়ালে ও পোস্টারে। তাঁর প্রতিবাদী কবিতাই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেবে বিশ্বসেরা কবি ও মহানায়কদের অগ্রভাগে।

ঋণ স্বীকার:

১. গাজী সাইফুল ইসলাম-অনূদিত মাহমুদ দারবিশের কবিতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৯।
২. আদিল মাহমুদ (অনুবাদ), ফিলিস্তিনি ক্ষতের দিনপঞ্জি, চৈতন্য প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০।
৩. শরীফ আতিকুজ্জআমান-সম্পাদিত মাহমুদ দারবিশ পাঠ ও বিবেচনা, সংবেদ, ঢাকা, ২০১৫।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *