বাংলার ইতিহাসঃ: বাংলাদেশ শব্দটি কখন থেকে ব্যবহার শুরু হয়

বাংলাদেশ শব্দটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’ ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয়হতে’ এর ন্যায় দেশাত্মবোধক গানগুলোর মাধ্যমে সাধারণ পরিভাষা হিসেবে বাংলাদেশ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার দূর্মর কবিতাতেও বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহার করেন। হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছাসে। অতীতে বাংলাদেশ শব্দটিকে দুটি আলাদা শব্দ হিসেবে বাংলা দেশ আকারে লেখা হত। ১৯৫০ দশকের শুরুতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা শব্দটিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল ও সভা-সমাবেশে ব্যবহার করতো। বাংলা শব্দটি বঙ্গ এলাকা ও বাংলা এলাকা উভয়ের জন্যই একটি প্রধান নাম।

শব্দটির প্রাচীনতম ব্যবহার পাওয়া যায় ৮০৫ খ্রিষ্টাব্দের নেসারি ফলকে। এছাড়াও ১১-শতকের দক্ষিণ-এশীয় পান্ডুলিপিসমূহে ভাংলাদেসা পরিভাষাটি খুঁজে পাওয়া যায়। ১৪শ শতাব্দীতে বাংলা সালতানাতের সময়কালে পরিভাষাটি দাপ্তরিক মর্যাদা লাভ করে। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার প্রথম শাহ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। উক্ত অঞ্চলকে বোঝাতে বাংলা শব্দটির সর্বা‌ধিক ব্যবহার শুরু হয় ইসলামি শাসনামলে। ১৬শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা অঞ্চলটিকে বাঙ্গালা নামে উল্লেখ শুরু করে।

বাংলা বা বেঙ্গল শব্দগুলোর আদি উৎস অজ্ঞাত; ধারণা করা হয় আধুনিক এ নামটি বাংলার সুলতানি আমলের বাঙ্গালা শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক ধারণা করেন যে, শব্দটি বং অথবা বাং নামক একটি দ্রাবিড়ীয়-ভাষী উপজাতি বা গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বং জাতিগোষ্ঠী ১০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, বং ছিলেন হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র, যেখানে হিন্দ ছিলেন হামের প্রথম পুত্র আর হামের পিতা ছিলেন নবি নুহ আঃ।

অন্য তত্ত¡ অনুযায়ী শব্দটির উৎপত্তি ভাঙ্গা (বঙ্গ) শব্দ থেকে হয়েছে, যেটি অস্ট্রীয় শব্দ ‘বঙ্গা’ থেকে এসেছিল, অর্থাৎ অংশুমালী। শব্দটি ভাঙ্গা এবং অন্য শব্দ যে বঙ্গ কথাটি অভিহিত করতে জল্পিত (যেমন অঙ্গ) প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেমনঃ বেদ, জৈন গ্রন্থে, মহাভারত এবং পুরাণে। “ভাঙ্গালাদেসা/ ভাঙ্গাদেসাম” (বঙ্গাল/বঙ্গল)-এর সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ রাষ্ট্রকূট সম্রাট তৃতীয় গোবিন্দ-এর নেসারি ফলকে উদ্দিষ্ট (৮০৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে), যেখানে ভাঙ্গালার রাজা ধর্মপালের বৃত্তান্ত লেখা আছে।

বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস চার সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে সেই ক্যালকোলিথিক যুগ থেকে চলে আসছে। দেশটির প্রারম্ভিক ইতিহাস হচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধ সাম্রাজ্যসমূহের মধ্যকার দ্ব›দ্ব ও প্রতিযোগিতার ইতিহাস। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। এয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি শাহ জালালের মতো সুন্নি দাঈদের নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে ইসলাম এদেশে প্রভাবশালী ধর্ম হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা মসজিদ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চল শাহী বাংলা হিসেবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ কর্তৃক শাসিত হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং আঞ্চলিক সাম্রাজ্যগুলোর উপর সামরিক আধিপত্যের সূচনা করে। ইউরোপীয়রা সেসময় এই শাহী বাংলাকে বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে ধনী দেশ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ হিসাবে পরিগণিত হয়। বাংলা সুবাহ গোটা মুঘল সাম্রাজ্যের জিডিপির প্রায় অর্ধেক এবং বিশ্ব জিডিপির ১২% উৎপাদন করে যা সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের থেকেও বেশি ছিল। এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রাথমিক শিল্পায়ন যুগের সূচনা করে। এ সময় রাজধানী শহর ঢাকার জনসংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলা নবাবদের অধীনে একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয় যার শাসনভার শেষ পর্যন্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে ন্যস্ত হয়। তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চল দখল করে। বাংলা সরাসরি ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখে কিন্তু এর ফলে তার নিজের শিল্পায়ন ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলা ও ভারতের পৃথকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশের সীমানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ফলে এই অঞ্চলটি নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর নয় মাস ব্যাপী সংগঠিত হওয়া রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রটি দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাপক দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মত অসংখ্য সমস্যার মুখোখুখি হয়। ২০০৯ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরে দেশটিতে আপেক্ষিক শান্তি স্থাপিত হয় এবং দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মানবসম্পদ ও পোশাকশিল্পে অগ্রগতির মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়ে সমগ্র বিশ্বে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *