শহীদ সাবের তুহিন: অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী বইমেলা।বাংলাদেশে হাজারো মেলার মাঝে বইমেলার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে মূলত এ মেলাকে কেন্দ্র করে। বাঙালীর ভাষা, সাংস্কৃতি বোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে বই মেলার ভিত্তি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই মাসে আয়োজিত এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এই মেলার রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন ইতিহাস।
জানা গেছে, ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। এই স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী নামে পরিচিত।১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অনেকেই অণুপ্রাণিত হোন।
পরবর্তীতে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় “বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি” নামক এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়।সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমী চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমীর আয়োজনে অমর একুশে বই মেলা ২০২৫।বিগত এক দশকের মতো এবারও মেলার আয়োজন হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। শুরু হয়েছে স্টল তৈরির প্রাথমিক কাজ।এইবারের মেলায় আনা হবে ভিন্নতা। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি এ মেলার উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠনের লক্ষ্যে আয়োজিতব্য এ মেলার এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে একুশের গ্রন্থমেলাও এক নতুন ধারায় প্রবেশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশের গ্রন্থমেলা একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী মধ্যবিত্তের কাছে বইমেলা ততদিনে মাসব্যাপী একটি উৎসবে রূপ পেয়েছে। তবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে মেলার বারোয়ারি রূপটি এতটাই প্রকট হয়েছিল যে স্টলগুলো থেকে উচ্চস্বরে বাজানো কবিতা ও গানের ক্যাসেটে কান পাতা দায় ছিল। ভেঁপু-বাঁশির সুর শোনা যেত টিএসসি কিংবা দোয়েল চত্বরে পৌঁছার আগেই। পুরো শাহবাগ থেকেই শুরু হয়ে যেত শিল-পাটা থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের পসরা। ২০১০ সাল থেকে এই মেলার প্রবর্তক জনাব চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয়। পূর্ববর্তী বছরে প্রকাশিত বইয়ের গুণমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারটি আনুষ্ঠানিক নাম ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’। এছাড়া স্টল ও অঙ্গসজ্জার জন্য দেয়া হয় ‘সরদার জয়েনউদদীন স্মৃতি পুরস্কার’। সর্বাধিক গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য সেরা ক্রেতাকে দেয়া হয় ‘পলান সরকার পুরস্কার’।
সবারই মিলন মেলা বাংলা একাডেমির বইমেলা। এদেশের সকল শ্রেণীর পাঠক সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বসবে অমর একুশে বইমেলা, কবে বসবে বাঙালীর মিলন মেলা। বইমেলায় জড়ো হতে থাকে দূর-দূরান্তের চেনা মুখগুলো।বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে অমর একুশে বইমেলা আবার কবে ফিরে আসবে এই অপেক্ষায়। ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি আর একুশের বইমেলা যেনো একই সূত্রে গাঁথা।